এই ছবিটা যে দেখছেন এই ছবির পেছনে রয়েছে বিশাল ইতিহাস


তারিখ জুলাই ১৯, ২০২৪


বিএনপি ডাক দিয়েছিল প্রেসক্লাবের সামনে জমায়েত এর। ছাত্রদলকেও যে করেই হোক এই প্রোগ্রামে দাড়াতে হবেই। ছাত্রদলের সভাপতি -সাধারণ সম্পাদকের উপর ব্যাপক প্রেসার। ১ দিন আগে ১৮ জুলাই ফ্যাসিস্টদের দোসরেরা ও স্বৈরাচারের পেটোয়া বাহিনী নির্বিচারে গুলি করেছে ঢাকাসহ সারাদেশে। অনেক লোককে মেরে ফেলেছে। এমনকি হেলিকপ্টারে করে গুলি, গ্রেনেড, ক্ষতিকর গ্যাস সবকিছুই মেরেছে। বিভিন্ন বাহিনীতে থাকা ফ্যাসীবাদের দালালদের উপর কঠোর নির্দেশ ছিল আন্দোললকারীদের শক্ত হাতে দমনের (ডাইরেক্ট গুলি)


তো ১৯ তারিখ নাছির উদ্দীন নাছির ভাইকে যেতে হবে প্রেসক্লাবের উদ্দেশ্যে। কিন্তু সময়ের আগেই প্রেসক্লাব ভরে যায় ফ্যাসীবাদের দোসর দালাল অফিসার ও বাহিনীতে তাদের অনুগত সদস্যদের দিয়ে। তারা গুলি করতে থাকে। নাছির উদ্দীন নাছির পল্টন মোড়ের দিকে কর্মীদের নিয়ে চেষ্টা করতে থাকেন প্রতিরোধ গড়ে তুলে সামনে এগোনোর। কিন্তু সমস্যা একটাই ছাত্রদল-বিএনপি নেতা-কর্মীদের হাতে ছিল  ইট-পাথর আর অপদিকের বাহিনীর সদস্যদের হাতে ছিল এডভান্স শটগান, পিস্তল, গ্রেনেড।


ধাওয়া- পালটা ধাওয়ার এক পর্যায়ে নাছির ভাই নেতা-কর্মীদের নিয়ে অবস্থান নেন কালভার্ট রোডে এবং সেখানেই শক্ত ঘাটি গেড়ে বসেন।


প্রতিরোধ চলতে থাকলো। ঘন্টার পর ঘন্টা। সেখানে নেতা-কর্মীদের নিয়ে শক্তভাবে আরো অবস্থান করছিলেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের সদস্য সচিব জনাব রবিউল ইসলাম নয়ন।  উপস্থিত ছিলেন বিএনপি'র কেন্দ্রীয় সহ-গণশিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক জনাব আনিসুর রহমান তালুকদার খোকন।


এই যে ঢালটি দেখছেন এই ঢালটি গুলি থেকে বাচার জন্য ঢাল। এই ঢাল বয়ে নিয়ে একটু একটু করে নেতা-কর্মীদের নিয়ে সামনে এগিয়েছেন, আবার একটু পিছিয়েছেন। এভাবেই চলছিল যুদ্ধ।


যুদ্ধের এক পর্যায়ে যখন কোনোভাবেই ছাত্রদল+যুবদল+বিএনপি নেতা-কর্মীদের থামানো যাচ্ছেনা তখন ফ্যাসিস্ট বাহিনী নিল অন্য কৌশল। বেপোরোয়া গুলি না চালিয়ে টার্গেট করে গুলি করা শুরু করলো। 


একটি গুলি, মাথার এসপাড়-ওসপাড় হয়ে গেল ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদল নেতা নবীন তালুকদার। লুটিয়ে পড়লেন সেখানেই। যায়গায় মৃত্যু।


দ্বিতীয় গুলিটি করা হল ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছিরকে উদ্দেশ্যে করে। লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে গুলিটি গিয়ে লাগলো নাছির ভাইয়ের পাশে অবস্থান করা ঢাকা কলেজ ছাত্রদলের সদস্য সচিব ( তৎকালীন যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক) মিল্লাদ হোসেন ভাইয়ের হাত-কাধ মিলিয়ে। এক দিয়ে ঢুকে অপর দিক দিয়ে বের হলো। মিল্লাদ ভাই মাটিয়ে লুটিয়ে পড়ার আগেই তাকে ধরে নিলেন ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ইব্রাহিম খলিল। মিল্লাদ ভাইয়ের রক্তে ইব্রাহিম ভাইয়ের সবুজ শার্ট ভিজে গেল রক্তে। মিল্লাদ ভাইয়ের টিশার্ট একটু পাসে চলে যাওয়ায় ফুটো দেখে প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছিল গুলি বোধহয় বুকে লেগেছে। পরবর্তীতে টিশার্ট খুলে ফেললে বোঝা যায় গুলি কোথায় লেগেছিল। ইব্রাহিম খলিল ভাই মিল্লাদ ভাইকে বাইকে বসিয়ে ইসলামি ব্যাংক হাসপাতালের দিকে পাঠিয়ে দেন। 


আরেকটি গুলি করা হল। নাছির উদ্দীন নাছিরকে বাচাতে গিয়ে এবার গুলিবিদ্ধ হল মহানগর উত্তর ছাত্রদলের সহ-সভাপতি ফখরুল ইসলাম ফাহাদ। নাছির ভাইকে আগলে ধরেছিল সে। তাই গুলি ঘাড় দিয়ে ঢুকে মুখ দিয়ে বের হয়েছিল। তাকে ধরাধরি করে ইসলামি ব্যাংক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। 


সেখানে উভয়কেই বলা হলো চিকিৎসা এখানে হবেনা। কারন ওইদিন ওই এলাকায় পুলিশ অবস্থান করছিল দুই জায়গায়। একটি প্রেসক্লাব হয়ে পল্টন মোড় থেকে নয়াপল্টন মোড়ের দিকে, অপরটি পল্টন থানার সামনে। প্রেস্রক্লাবের পুলিশ আগাচ্ছিল পার্টি অফিস, শান্তিনগর ও পার্টি অফিসের সামনে। আর ইসলামি ব্যাংক হাসপাতালে বিএনপি নেতা-কর্মীরা আছে  তারা জানতো। সেখানে যেকোনো সময় রেইড দিবে এই কথা হাসপাতাল কতৃপক্ষ জানতো। তাই আহতদের এম্বুলেন্সে করে নেয়া হলো পাশেই অবস্থিত অরোরা হাসপাতালে।


এম্বুলেন্স থেকে ফাহাদ ভাইকে নামিয়েছিলাম আমি। তার রক্তে আমার সাদা শার্ট ভিজে গিয়েছিল। তাদের ইমার্জেন্সিতে নিয়ে প্রাথমিকভাবে অপারেশন করা হয়। হাসপাতাল পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হয় যেনো ফ্যাসিস্ট বাহিনীর কেউ প্রবেশ না করে। আর আহতদের অন্য নাম ও অন্য ইঞ্জুরি দেখিয়ে (রোড এক্সিডেন্ট) ভর্তি করা হয়েছিল যেনো কেউ সন্দেহ করতে না পারে। পরবর্তীতে তাদের সাথে থেকে তাদের চিকিৎসা নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমাকে দিয়েছিলেন নাছির উদ্দীন নাছির ভাই (এসব দিনের ঘটনা অন্যদিন বলবো)


ওইদিন হাসপাতালে নির্দেশনা দেয়া ছিল আন্দোলনে আহত রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দিবে। প্রথমে মনে করেছিলাম হয়তো রোগীদের কন্ডিশন দেখে এই দুইজনের ভর্তি নিয়েছিল কিনা।  কিন্তু পরে জানতে পারি বিএনপি'র স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ড. রফিক ভাই ও নাছির উদ্দীন নাছির ভাই হাসপাতালের কতৃপক্ষকে ম্যানেজ করেছিলেন এই দুইজনের ভর্তি নেয়ার জন্য। 


এই দিন ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক বিএনপি'র পার্টি অফিসের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিলেন পল্টন থানার পুলিশদের সাথে লড়াই করে। মুহূর্মুহু গুলির সামনে দাড়িয়েছিলেন ভয় না পেয়ে নিজ পরিচয়ে। 


পরের দিনই ঢাকা শহরে কারফিউ ভেঙ্গে প্রথম মিছিল করেছিলেন ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির। ওইদিন শ্যুট এট সাইট অর্ডার ছিল। মৃত্যুঝুকি একটা মানুষ কতবার নিতে পারে। আর একা তো নেননি, নেতা-কর্মীদের দিয়েও নিয়িয়েছেন। কারন ফ্যাসীবাদের পতন, গণতন্ত্র অর্জন।


আন্দোলন, আহত-শহীদদের খোজ নেয়া, যুদ্ধের কৌশল ঠিক করা, সমন্বয়কদের সাথে সমন্বয়, বিএনপি'র হাই কমান্ডের সাথে সমন্বয় সবই চালিয়ে যেতে হয়েছে জীবননাশের হুমকি নিয়েই। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী + গোয়েন্দা বাহিনী তন্ন তন্ন করে খুজেছে তাকে। সকল কিছু উপেক্ষা করে লড়াই চালিয়ে গেছেন। 


অথচ সেদিন নবীন তালুকদারের জায়গায় সেও থাকতে পারতো। দেশের সর্ববৃহৎ ছাত্রসংগঠনের সাধারণ সম্পাদক যার সংগঠনের ১৪৩ জন কর্মী শহীদ হয়েচেন এই জুলাই আন্দোলনে। যে সংগঠনের প্রতিটি কর্মী সংগঠনের পরিচয়ে লড়াইয়ে ছিল জুলাই আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে। এতকিছুর পরেও কিন্তু কখনো নিজে থেকে ক্রেডিটবাজি করতে দেখিনি।  কিন্তু নিজ পরিচয় লুকিয়ে ছন্মনামে ম্যাসেজ পাঠানো,  রাজপথে লড়াইয়ের একটা ছবি দেখাতে না পারা লোকজন আজ ক্রেডিটের জন্য মরিয়া।


হয়তো লিখতাম না কিছুই। কি করেছি থেকে যেতো আড়ালে। কিন্তু নীরবতা ভেঙ্গে আমাদের লিখতে হচ্ছে বাধ্য হয়েই।


বেচে আছি এই অনেক। আমরা কিছু বলবো না। কিন্তু যখনই আমাদের অন্যায়ভাবে বাদ দেয়া হবে আমরা তুলে ধরবো আমাদের অবদান।


বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল জিন্দাবাদ।


কার্টেসীঃ Mehedi Hasan