জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কার্যক্রম নিয়ে আগ্রহ ও প্রত্যাশা যেমন অনেক তেমনি হতাশা ও উৎকণ্ঠাও রয়েছে জনমনে।
বিএনপি’র পক্ষ থেকে আমরা যেমন ৬টি সংস্কার কমিশনের কার্যক্রম সক্রিয় ভাবে অংশ নিয়েছি তেমনি ঐকমত্য কমিশনের প্রতিদিনের আলোচনায় আমাদের প্রতিনিধিগণ কার্যকর অংশগ্রহণ করে চলেছেন।
বিভিন্ন বিষয়ে ঐকমতে পৌঁছার জন্য আমাদের প্রতিনিধিগণ সভায় অংশগ্রহণকারী অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা এবং অনেক বিষয়ে ছাড় দিয়ে হলেও একমত হয়ে কমিশনের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াসকে সহযোগীতা করেছেন।
কিন্তু দীর্ঘ আলোচনার পর সংস্কার কমিশনগুলো যে সব প্রস্তাব পেশ করেছেন, তার বিপরীত কিম্বা নতুন নতুন প্রস্তাব উত্থাপন এবং তা নিয়ে অনেক সময় অচলাবস্থা সৃষ্টির কারনে কার্যক্রম বিলম্বিত হচ্ছে। ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার আগ্রহী বলেই আমাদের প্রতিনিধিগণ ধৈয্য ধরে আলোচনা শুনছেন এবং তথ্য প্রমান ও যুক্তি দিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে কমিশনকে সহযোগীতা করছেন।
রাষ্ট্র পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ কতিপয় প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করার নামে জনগণের নির্বাচিত সংসদ, নির্বাচিত সরকার তথা রাষ্ট্র কাঠামোকে দূর্বল ও অকার্যকর করার কোন প্রস্তাবের যুক্তিসঙ্গত বিরোধীতা সংস্কারের মূল উদ্দ্যেশের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ বলে আমরা মনে করি। জনগণের দ্বারা নির্বাচিত জনগণের কাছে দায়বদ্ধ এবং জনগণকে জবাবদিহীতা করতে বাধ্য কোনো সরকারকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় দুর্বল ও অকার্যকর করা অবশ্যই সংস্কারের মূল আকাঙ্খার সাথে সাংঘষিক। ফলে এমন কোন প্রয়াসে সমর্থন জানানো সংস্কারের মূল উদ্দেশ্যের পরিপন্থি বলে তা থেকে বিরত থাকার অর্থ সংস্কার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্থ করা নয় বরং এই প্রক্রিয়াকে সহযোগীতা করা।
প্রিয় সাংবাদিকবৃন্দ,
৬টি সংস্কার কমিশনের মধ্যে পুলিশ সংস্কার কমিশনের বিষয় এখনও আলোচনায় আসেনি। তবে ঐ কমিশনে আমাদের দলের প্রতিনিধিবৃন্দের কাছে আমরা যতটুকু জেনেছি তাতে র্যাব বিলুপ্তি সহ প্রায় সব বিষয়েই ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে।
দুদক সংস্কার কমিশনে কতিপয় ছাড় দিয়ে ৪৭টি সুপারিশের ৪৬টিতেই আমরা সম্মতি জানিয়েছি। শুধু ২৯নং সুপারিশে আইনের মাধ্যমে করার পরিবর্তে আমরা আদালতের অনুমতি নেয়ার বিদ্যমান বিধান অব্যাহত রাখার কথা বলেছি। আমরা মনে করি এটা না হলে দুদকের কার্যক্রমকে অহেতুক বিলম্বিত করার সুযোগ সৃষ্টি হবে।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের ২০৮টি সুপারিশর মধ্যে ১৮৭টি প্রস্তাবে আমরা একমত হয়েছি এবং ৫টিতে আংশিক একমত হয়েছি। ৫টি সুপারিশে আমরা ভিন্নমত প্রদান করেছি। ১১টি প্রস্তাবে আমরা একমত হতে পারিনি- যেগুলো দেশে প্রদেশ সৃষ্টি, পদোন্নতি ও অন্যান্য প্রশাসনিক অসংগতির বিষয়ে। উল্লেখযোগ্য যে, পদোন্নতির বিষয়ে আপীল বিভাগের রায় কার্যকর রয়েছে।
বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ ৮৯টি সুপারিশের মধ্যে ৬২টি সুপারিশে আমরা একমত হয়েছি এবং ৯টিতে আংশিক ভাবে একমত হয়েছি। ১৮টিতে ভিন্নমত পোষণ করে যুক্তিসহ পরামর্শ দিয়েছি। উল্লেখযোগ্য যে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বিষয়ক সকল প্রস্তাবে আমরা একমত হয়েছি। তবে এর কিছু বিষয়ে নির্বাচিত সংসদে আইন প্রণয়ন কিম্বা ইতোমধ্যে কোন অধ্যাদেশ হলে তা সংসদে রিটিফাই ও সাংবিধানিক সংশোধনীর প্রয়োজন হবে।
নির্বাচনী ব্যবস্থা বিষয়ক সংস্কার কমিশনের ২৪৩টি সুপারিশের মধ্যে ১৪১টিতে আমরা একমত হয়েছি এবং ১৪টিতে আংশিক ভাবে একমত হয়েছি। ৬৪টিতে আমরা ভিন্নমতসহ একমত হয়েছি। অর্থাৎ এসব বিষয়ে পরিবর্তনে একমত হয়ে বিভিন্ন আইনে ও বিধিতে সংশোধনী অধিকতর কার্যকর হবে তা প্রস্তাব করেছি। ২৪টি বিষয়ে আমরা একমত হতে পারিনি। উল্লেখযোগ্য যে, নির্বাচনী ব্যবস্থা সংক্রান্ত ১২টি আইন ও ৬টি নীতিমালা আছে। এ বিষয়ে রাষ্ট্রীয় সংবিধানেও নির্দিষ্ট বিধান আছে। এসব প্রস্তাবের বেশ কয়েকটি বাস্তাবায়নযোগ্য নয় এবং কয়েকটি নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনে স্পষ্টতই বাধা সৃষ্টি করে তাদের সাংবিধানিক স্বাধীনতা ক্ষুন্ন করবে। আমরা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আনীত সকল প্রস্তাবে একমত হয়েছি। আইনী সংস্কারের বিষয়ে আলোচনা অব্যহত আছে।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের ১৩১টি সুপারিশে আমরা দফা ওয়ারী মতামত দিয়েছি। অধিকাংশ সুপারিশে একমত হয়েছি। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘৭০’ অনুচ্ছেদ ও প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ। দুই বিষয়েই আমরাই ছাড় দিয়েছি। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নির্দিষ্ট করে দেয়ার বিধান বিশে^র কোথাও না থাকার পরেও ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার স্বার্থে আমরা সম্মত হয়েছি।
প্রধান বিচারপতি নিয়োগের বিষয়েও আমরা আমাদের প্রস্তাব থেকে সরে এসে একমত হয়েছি।
জাতীয় সংসদে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির পদ বিরোধী দলকে দেয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ৪টি সহ আসন সংখ্যার অনুপাতে সভাপতির পদ দিতেও আমরা সম্মত হয়েছি।
রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সংক্রান্ত আর্টিকেল ৪৯ পরিবর্তনে আমরা সম্মত হওয়ায় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে।
এছাড়া তত্ববধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন, ন্যায়পাল আইন যুগোপযোগী করা, জাতীয় সংসদের নির্বাচনী এলাকার সীমানা বিন্যাসে সংস্কার আনার জন্য সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদ সংশোধন ও আইনের মাধ্যমে বিশেষায়িত কমিটি গঠনেও আমরা একমত হয়েছি।
বিভাগীয় পর্যায়ে হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সম্মত হয়ে আমরা তা বিচার বিভাগের সাথে আলোচনার মাধমে বাস্তবায়নে পরামর্শ দিয়েছি। কারণ ইতোপূর্বে ১৯৮৮ সালে এমন উদ্যোগকে উচ্চ আদালত বাতিল করে দিয়েছিল।
এমন বহু সংস্কার প্রস্তাবে শুধুই ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার স্বার্থে আমরা একমত হয়েছি যেগুলি বাস্তবায়ন অত্যন্ত দূরুহ এবং যে উদ্দেশ্যে এসব প্রস্তাব তা অর্জনের সাফল্য প্রশ্ন সাপেক্ষ। রাষ্ট্র পরিচালনার এবং সংসদীয় কার্যক্রম দীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা যুক্তিগ্রাহ্য মতামত দিয়ে আমাদের দায়িত্ব পালন করেছি।
প্রিয় সংবাদিক বন্ধুগণ,
ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা অব্যাহত আছে। সংস্কার কমিশন সমূহের প্রস্তাবের উপর আলোচনা করে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার কথা থাকলেও নিত্য নতুন এমন সব প্রস্তাব আসছে যে গুলো রাজনীতি, রাষ্ট্র ও সংসদ পরিচালনায় বিপুল প্রভাব ফেলবে। এসব প্রভাব ইতিবাচক হলে অবশ্যই তা জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। কিন্তু রাষ্ট্রের মালিক জনগণকে সম্পৃক্ত না করে তাদের প্রতিনিধিত্ব কিম্বা প্রত্যাশার ক্ষেত্রে বড় কোন পরিবর্তন করার অধিকার কোন ব্যক্তি দল কিম্বা কমিশনের আছে কিনা তা’ বিবেচনায় নিতে হবে।
এসব বিষয়ে সুস্পষ্ট কোন প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা শুরু হয়নি বলে আমরা মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকছি।
দীর্ঘ প্রায় দেড় যুগ স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করে বিএনপি শুধু টিকে থাকেনি বরং অধিকতর শক্তিশালী ও জনপ্রিয় হয়েছে। শত শহীদের রক্তে, গুম, খুনের শিকার সহকর্মীদের আত্মত্যাগে আর লাখো নেতা-কর্মীর অবর্ণনীয় দুঃখ-শোকে বিএনপি’র ঐক্য আরও দৃঢ় হয়েছে। এই ঐক্যবদ্ধ শক্তি ও সমর্থ নিয়ে এবং দীর্ঘ দিন রাষ্ট্র পরিচালনার অভিজ্ঞতা নিয়ে বিএনপি দেশে আবারও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় ইতিহাস অর্পিত দায়িত্ব পালনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদের পুনরুত্থান রোধে আমরাই সবচেয়ে সক্রিয়। ব্যক্তি কিম্বা প্রতিষ্ঠানকে অধিক ক্ষমতা দিলে যেমন ফ্যাসিবাদ কায়েম হয় ঠিক তেমনি নির্বাচিত সরকার এবং সংসদকে ক্ষমতাহীন করলে রাষ্ট্র দুর্বল, ভঙ্গুর ও অকার্যকর হয়।
আমরা যেন দলীয় স্বার্থের উর্দ্ধে থেকে হাজারো শহীদের রক্তে অর্জিত পরিবর্তনের এই সুযোগকে গঠনমূলক ভাবে কাজে লাগাই এবং মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ, ৯০’এর ছাত্র গণঅভূত্থান এবং ২০২৪ এর জুলাই-আগষ্টের ছাত্র-শ্রমিক-জনতার গণঅভূত্থানের আকাঙ্খা ধারণ করে একটি বৈষম্যহীন, মানবিক ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ না হই।
---
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর
মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি
0 Comments
Post a Comment