নির্ভীক নারীরা - যে রাঁধে সে চুল বাঁধে’ এ কথাগুলো এখন অতীত। বিদ্রোহী কবির ভাষায়— 


জুমানা নায়িলাত শখ, মালেকা খাতুন সারা ও শায়লা ইসলাম বীথি
জুমানা নায়িলাত শখ, মালেকা খাতুন সারা ও শায়লা ইসলাম বীথি


 যে রাঁধে সে চুল বাঁধে’ এ কথাগুলো এখন অতীত। বিদ্রোহী কবির ভাষায়— ‘কোন কালে একা হয়নি ক’ জয়ী পুরুষের তরবারি, প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয় লক্ষ্মী নারী।’ একসময় নারী আড়াল থেকে শক্তি ও সাহস জোগাতেন। তবে নারী এখন শক্তি আর সাহস জুগিয়েই ক্ষান্ত হন না; তারা পাশে থেকে, সঙ্গে থেকে, কখনো সামনে থেকেও নেতৃত্ব দেন। অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন বলিষ্ঠ কণ্ঠে, জ্বলে ওঠেন আপন আলোতে। যুদ্ধের ময়দানে মারণাস্ত্র হাতে দৃঢ়তার সঙ্গে নেতৃত্ব দেন। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, ২০২৪’-এ সারা দেশ থেকে যুক্ত হয়েছিলেন অনেক নারী। এসব সাহসী নারীর বলিষ্ঠ অংশগ্রহণের ফলে আন্দোলন বেগবান হয়েছিল, সফল হয়েছিল। জুলাইয়ের এমন কয়েকজন নির্ভীক নারীর কথা তুলে ধরা হয়েছে।




জুমানা নায়িলাত শখ



 কোনো ষড়যন্ত্র যেন আমাদের ঐক্য ভাঙতে না পারে’ 




 ৫ জুন থেকে শুরু হওয়া কোটা আন্দোলন যখন ক্রমে বিস্তার লাভ করছিল এবং রূপ নিয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে, তখন তিনি আর ঘরে বসে থাকতে পারেননি। তিনি ৩০ জুন থেকে আন্দোলনের শেষ পর্যন্ত নিয়মিত রাজপথে থেকেছেন। শখ বলেন, ‘যেকোনো আন্দোলনে পুরুষের মতো অনেক নারীরও অংশগ্রহণ বা অবদান থাকে, নারীরাও নেতৃত্ব দেন। নারীর এই নেতৃত্বকে সমাজ কীভাবে দেখে বলে মনে করেন?’—এ প্রশ্নের উত্তরে শখ বলেন, ‘নারী নেতৃত্বকে সমাজ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে এবং তা অনেকাংশে সমাজের প্রেক্ষাপট, সংস্কৃতি ও মানসিকতার ওপর নির্ভর করে। সমাজের একটি অংশ নারীর নেতৃত্বকে ক্ষমতায়নের উদাহরণ হিসেবে দেখে। এটি প্রমাণ করে, নারীরা কেবল গৃহস্থালি কাজেই সীমাবদ্ধ নন, তারা সমাজ, রাজনীতি ও আন্দোলনে সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম। সমাজে নারীর নেতৃত্বকে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা শুরু হলেও বৈষম্য ও পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব পুরোপুরি দূর হয়নি। তবে আশার কথা, দিন দিন নারীর নেতৃত্বকে আরো বেশি গ্রহণযোগ্য ও স্বাভাবিক হিসেবে দেখার প্রবণতা বাড়ছে।’ শখ এমন একটি বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেন, যা সমতাভিত্তিক, উন্নত এবং সব নাগরিকের জন্য সুযোগ-সুবিধায় সমৃদ্ধ, যা কেবল অর্থনৈতিক উন্নয়নেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং সামাজিক ন্যায়বিচার, মানবাধিকার ও পরিবেশগত উন্নয়নও নিশ্চিত করবে। নতুন বাংলাদেশ যেন একটি উদাহরণ হয়ে ওঠে, যেখানে মানুষ শান্তি, সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তা নিয়ে বসবাস করতে পারে। এর ভিত্তি হতে হবে ঐক্য ও ন্যায়বিচারের ওপর। সবশেষে শখ বলেন, ‘দেশের সর্বস্তরের মানুষের কাছে বিশেষ অনুরোধ, মনে রাখবেন আমি, আপনি, আমরা—সবাই মিলেই বাংলাদেশ। আমরা সবাই মিলেই আগামীর সম্ভাবনাময় সূর্য। যত কিছুই হোক না কেন দেশ ও দশের প্রয়োজনে আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। কোনো ষড়যন্ত্র যেন আমাদের ঐক্য ভাঙতে না পারে।’ 

মালেকা খাতুন সারা



 মানুষের ঐক্যই কোনো আন্দোলনের প্রকৃত শক্তি।


৪ আগস্ট, সিলেটের বন্দর পয়েন্টের সেই আন্দোলন জুলাই ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় দিন হয়ে থাকবে। সেদিন সিলেট শহর ছিল কার্যত স্তব্ধ। দোকানপাট অধিকাংশই বন্ধ। সন্ত্রাসী হামলার শঙ্কায় পথচারীরাও ভীত। পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী সমন্বয়ক সারাসহ সবাই বন্দর পয়েন্টে একত্রিত হয়েছিলেন। এ যেন জনতার সমুদ্র। এই সমুদ্রকে পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজন একটি মাইক। সেই দিন তাদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল একটি মাইক জোগাড় করা। বিভিন্ন দোকানে ফোন করেও সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল না। অবশেষে এক মাইকের দোকানদার, তাদের অবস্থার কথা শুনে দোকান খুলে মাইক দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি বললেন, ‘আমি হয়তো রাজপথে নেমে তোমাদের পাশে দাঁড়াতে পারছি না, কিন্তু আমার মাইকটুকু তোমাদের কাজে লাগুক, এটুকুই আমার সহায়তা।’ এই ঘটনা সারাকে এখনো মুগ্ধ করে। আক্রমণের ভয়াবহতা এবং সাধারণ মানুষের সাহস: ১৮ জুলাই, দুপুরের গণসমাবেশে যখন রাজপথ সরব, ঠিক তখনই পুলিশ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কিছু কর্মী একসঙ্গে সবার ওপর আক্রমণ চালায়। ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার মধ্যে সারাসহ কিছু সহযোদ্ধা আহত হন। এক মুহূর্তে শহরের সাধারণ মানুষ এগিয়ে এলেন। কেউ আহত বন্ধুদের নিরাপদে সরিয়ে নিয়ে গেলেন, কেউ পানি বা গ্লুকোজ নিয়ে ছুটে এলেন। আন্দোলনে সরাসরি অংশগ্রহণ করতে না পারলেও মানুষের এই অদৃশ্য সমর্থন সারাদের অনুপ্রাণিত করেছিল। আরো একটি ঘটনা উল্লেখ করেন সারা। “সারা দিনের ক্লান্ত শরীর, কোথাও কোনো খাবার নেই। আমরা সারা দিন আন্দোলন শেষে সন্ধ্যায় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। তখন একজন বয়স্ক মুরুব্বি, মাথায় পাতিল নিয়ে খাবার বিতরণ করছিলেন। জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আঙ্কেল, আপনি তো জীবন ঝুঁকিতে আছেন, ছাত্রলীগ আর পুলিশের তাণ্ডব চলছে!’ উনি বলেছিলেন, ‘আমি যুদ্ধের ময়দানে আছি। এখানে যদি মরেও যাই, তবে সেটাই হবে শহীদি মৃত্যু।’ এমন সাহসী মানুষেরাই তো আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশের অংশ।” এখানেই শেষ নয়। একজন বয়স্ক পথচারী, কাছে ছুটে এসে বলেছিলেন, ‘বাবারা, অন্যায় কখনো চিরস্থায়ী হয় না। তোমাদের সাহসেই দেশটা নতুন আলো পাবে।’ তার সেই কথা সারাকে এখনো শক্তি জোগায়। সারা মনে করেন, এসব কারণেই তাদের লড়াই সেদিন থেমে থাকেনি। শাসকের নিপীড়ন যতই বাড়ুক, ন্যায়ের পক্ষে তাদের আওয়াজ ততই জোরালো হয়েছিল। আর সেই দিন সারা শিখেছেন, মানুষের ঐক্যই কোনো আন্দোলনের প্রকৃত শক্তি। সারার পরিবারের সমর্থনই এই সংগ্রামে তাকে সবচেয়ে বেশি সাহস দিয়েছে। ১৮ জুলাই হামলার পর আমাকে বাড়ি ছেড়ে থাকতে হয়েছিল ৫ আগস্ট পর্যন্ত। তবে আমার বাবা-মা কখনোই আমাকে ঘরে আটকে রাখেননি। বরং তারাই আমাকে বলতেন, ‘সত্যের পক্ষে থেকো, বিজয় আসবেই।’দেশ নিয়ে সারা স্বপ্ন দেখেন,‘গণতন্ত্র, সুশাসন, ন্যায়বিচার আর দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে চাই। এটাই তো নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন।’
শায়লা ইসলাম বীথি
নিজের দেশে আপন অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই’ 

 ‘আন্দোলন শুরু হয়েছিল কোটা সংস্কারের জন্য এবং পরে দেখা গেল সেই ছাত্রদেরই পেটানো হচ্ছে। ধৈর্যের সীমা অতিক্রম হয় ১৬ তারিখ। একজন এসে বুক চিতিয়ে দিল, আর আপনি গুলি করে দিলেন—এটা দেখার পর সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ অন্তত ঘরে বসে থাকবে না।’ এ কথাগুলো আন্দোলনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রাস্তায় সক্রিয় থাকা সাহসী যোদ্ধা শায়লা ইসলাম বীথির। আন্দোলনের দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে শায়লা আবেগাপ্লুত হয়ে বলেন, ‘আন্দোলনের সবচেয়ে ইতিবাচক ব্যাপার ছিল, একদম অপরিচিত মানুষটাকেও খুব পরিচিত লাগে। পাশের মানুষটাকে চিনি না, কিন্তু সে প্রয়োজনে আমার হাতটা শক্ত করে ধরছে, আমার সঙ্গে স্লোগান দিচ্ছে, আমার জন্য পানির বোতল এগিয়ে দিচ্ছে। আন্দোলনের একদম শেষের দিকে দেশের ভয়াবহ অবস্থা। ৪ আগস্ট শহীদ মিনার থেকে চার শহীদকে সঙ্গে নিয়ে আমরা শাহবাগের দিকে এগিয়ে আসছিলাম। স্পষ্ট মনে আছে, আমার ডান হাতটা যে আপুটা ধরেছিল, তাকে আমি চিনি না। কিন্তু সেই হাত ধরার যে শক্তি, সেটা ভাষায় লিখে প্রকাশ করা যাবে না। আমাদের ওপর গুলি করা হয়। পুরো আন্দোলনে আমার পাশে থাকা বন্ধু তুষারকে তখন হারিয়ে ফেলি কয়েক ঘণ্টার জন্য। আমাকে সেই টালমাটাল সময় যে বা যারা পাশে রেখেছিল, তাদেরও আমি চিনি না। এই ভরসার হাতগুলোই তো এনে দিয়েছে আমাদের নতুন বাংলাদেশ।’ তীব্র মনোবেদনা নিয়ে তিনি বলেন, ‘আন্দোলনের মোটিভটাই হঠাৎ কেমন বদলে গেল। একটা অধিকার আদায়ের দাবি থেকে হয়ে গেল নিজের দেশে আপন অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। নিজের দেশে দাঁড়িয়ে নিজের দেশের মানুষের সঙ্গেই লড়তে হচ্ছে। আমাদের সরকার আমাদেরই গুলি করে মেরে ফেলছে। এটা খুব দুঃখজনক ব্যাপার ছিল।’ আন্দোলনে নারীর নেতৃত্ব নিয়ে শায়লা বলেন, ‘আমি নারী-পুরুষকে আলাদাভাবে দেখি না। আমি সবাইকে মানুষ হিসেবে দেখি এবং মনে করি, প্রতিটি মানুষের খুব শক্তিশালী মনোভাব থাকা উচিত, যেকোনো পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করার জন্য। আমার মনে হয়, যৌথ আলোচনা ও সমঝোতার মধ্যে পরিচালিত পরিবারে বেড়ে উঠলে নারী নেতৃত্ব গ্রহণ করাটা আমাদের কাছে সহজ ও স্বাভাবিক হবে।’ নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে শায়লা বলেন, ‘সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা সেই বাংলাদেশকে ফিরে পেতে চাই। এ দেশে মানুষের একসঙ্গে কাজ করার মনোভাব চাই। দাঙ্গা-হাঙ্গামার পরিবর্তে সমঝোতা, আলোচনা, ঐক্যবোধ এবং একসঙ্গে দেশ গড়ার প্রচেষ্টা এটুকুই প্রত্যাশা।’ বিষয়: আমার দেশ নিউজ নারী জুলাই অভ্যুত্থান