Responsive Advertisement

Top News

জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করতে হবে দুই বছরের মধ্যে ।

 



আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সরকার গঠনের দুই বছরের মধ্যে ‘জুলাই সনদ’ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করতে যাচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো। দেশের ৩০টি রাজনৈতিক দল ও জোটের কাছে গতকাল সোমবার ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এর অংশবিশেষের খসড়া পাঠানো হয়েছে। এই খসড়ায় দলগুলোকে সনদ বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। আগামী ৩ বা ৪ আগস্ট ‘জুলাই সনদ’ স্বাক্ষর হতে পারে।

দলগুলোকে পাঠানো খসড়ায় জুলাই সনদের পটভূমি, সংস্কার কমিশন ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন, কার্যক্রম এবং জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের অঙ্গীকারনামা রয়েছে। তবে রাজনৈতিক ঐকমত্যে হওয়া সংস্কার সুপারিশগুলো দ্বিতীয় ধাপের আলোচনা শেষে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।


খসড়ায় বলা হয়েছে- সংবিধান, বিচারব্যবস্থা, নির্বাচনব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশি ব্যবস্থা ও দুর্নীতি দমন ব্যবস্থার বিষয়ে ঐকমত্যের ভিত্তিতে যেসব প্রস্তাব ও সুপারিশ গ্রহণ করা হয়েছে তা বাস্তবায়নের জন্য সংবিধানসহ বিদ্যমান আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন, সংযোজন, পরিমার্জন, লিখন ও পুনর্লিখন বা নতুন আইন প্রণয়ন, বিধি প্রণয়ন বা বিদ্যমান বিধি ও প্রবিধির পরিবর্তন বা সংশোধনের প্রতিশ্রুতি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

খসড়া সনদের বিষয়ে কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ আমার দেশকে বলেন, তারা সনদের ভাষাটি পর্যালোচনার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে খসড়া পাঠিয়েছেন। যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হবে, তা চূড়ান্ত সংলাপ শেষে চূড়ান্ত সনদে সংযোজন করা হবে।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সংলাপের জন্য সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা, জনপ্রশাসন ও দুর্নীতি দমন কমিশনÑ পাঁচটি সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলোর মধ্যে ১৬৬টির ওপর আলোচনার সিদ্ধান্ত নিয়ে লিখিত প্রস্তাবের জন্য ৩৮টি রাজনৈতিক দল ও জোটের কাছে পাঠিয়েছিল। দলগুলো থেকে জবাব পাওয়ার পর কমিশন প্রথম ধাপে ৩২টি দল ও জোটের সঙ্গে ৪৪টি বৈঠক করে। প্রথম ধাপে ঐকমত্য হয়নি এমন ১৯টি বিষয় নিয়ে দ্বিতীয় পর্যায়ে ৩০টি দল ও জোটের সঙ্গে যৌথ বৈঠক করে কমিশন। ২০টি বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করে একটি ঐকমত্য পর্যায়ে পৌঁছেছে রাজনৈতিক দল ও ঐকমত্য কমিশন। এর ভিত্তিতে জুলাই সনদ সই হতে যাচ্ছে।

ঐকমত্য হলো যেসব গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে

যেসব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছেছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- এক ব্যক্তি ১০ বছরের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না; সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ পরিবর্তন; সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিত্ব; নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণ; রাষ্ট্রপতির ক্ষমা-সম্পর্কিত বিধান; উচ্চ আদালতের বিকেন্দ্রীকরণ; পর্যায়ক্রমে উপজেলা পর্যায়ে নিম্ন আদালত স্থানান্তর; জরুরি অবস্থা জারির ক্ষমতা; প্রধান বিচারপতি নিয়োগ; নির্বাচন কমিশন গঠন পদ্ধতি; প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান সংস্কার এবং স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন। এর বাইরে আরো দু-একটি বিষয়ও ঐকমত্যের পর্যায়ে রয়েছে। উল্লেখ্য, পাঁচটি সংস্কার কমিশনের ১৬৬টি সুপারিশের মধ্যে দ্বিতীয় পর্যায়ে আলোচনার জন্য নির্ধারিত ১৯টি বাদে ১৪৭টির বিষয়ে প্রথম ধাপেই সুরাহা হয়েছে। এর মধ্যে দলগুলো যেসব বিষয়ে একমত হয়েছে সেটা জুলাই সনদে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কোন কোন বিষয়গুলোতে ঐকমত্য হয়নি সেটাও ভিন্নভাবে উল্লেখ করা থাকবে বলে জানা গেছে।

জাতীয় সনদের প্রেক্ষাপটের বিষয়ে বলা হয়-‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ এসেছে ২০২৪ সালের জুলাই মাসে দেশব্যাপী ঘটে যাওয়া নজিরবিহীন ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায়। ওই আন্দোলনের মূল দাবি ছিল ন্যায়বিচার, সুশাসন ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা। এতে এক হাজারেরও বেশি নিহত এবং আরো অনেক আহত হন। এই ঘটনা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি মোড় ঘুরিয়ে দেয়।

যে অঙ্গীকার করতে যাচ্ছে দলগুলো : দুই বছরের মধ্যে জুলাই সনদ বাস্তবায়নসহ ৭ দফা অঙ্গীকার করতে যাচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো। এগুলো হচ্ছে- হাজারো মানুষের জীবন ও রক্ত এবং অগণিত মানুষের সীমাহীন ক্ষয়ক্ষতি ও ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত সুযোগ এবং এর প্রেক্ষিতে জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হিসেবে দীর্ঘ ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রণীত ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে গ্রহণ করা ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এর পূর্ণ বাস্তবায়নে নিশ্চয়তা প্রদান; জুলাই সনদের অন্তর্গত সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশ বাস্তবায়ন ও টেকসইকরণ; সংবিধান ও আইনের সংশোধন এবং নতুন আইন প্রণয়ন; সনদ বাস্তবায়নের প্রতিটি ধাপে আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষার পূর্ণ নিশ্চয়তা বিধান; আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষা প্রদানের প্রতিশ্রুতি এবং ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে সংবিধানে যথাযোগ্য স্বীকৃতির অঙ্গীকার করা।

রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো খসড়া ‘জুলাই সনদে’ বলা হয়েছে- মুক্তিযুদ্ধের ৫৩ বছরেও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামো গঠনের আকাঙ্ক্ষা অর্জন করা যায়নি। গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ও সংস্কৃতি বিকাশের ধারা বারবার হোঁচট খেয়েছে। রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে টেকসই ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। রাষ্ট্রকাঠামোতে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ এবং ক্ষমতার অপব্যবহারে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো অকার্যকর ও বিচারহীনতার সহায়ক হিসেবে পরিচালনা করা হয়েছে।

এতে আরো বলা হয়, ২০০৯ সালে দলীয় সরকার রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে ক্রমান্বয়ে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে জলাঞ্জলি দিয়ে অগণতান্ত্রিক চরিত্র ধারণ করতে থাকে। তারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও সমালোচকদের মানবাধিকার হরণ, গুম, খুন, নিপীড়ন-নির্যাতন, মামলা ও হামলার মাধ্যমে একটি নৈরাজ্যকর ও বিভীষিকাময় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। রাষ্ট্রযন্ত্রকে স্বৈরতান্ত্রিকভাবে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীবন্দনার জন্য নিবেদিত রাখা হয়। দেড় দশকে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকার জনস্বার্থের বিরুদ্ধে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার উদ্দেশ্যে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সংবিধানের বিকৃতি সাধন, বিভিন্ন নিবর্তনমূলক আইন প্রণয়ন, নির্বাচনি ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা, বিচার বিভাগ ও জনপ্রশাসন দলীয়করণ এবং দুর্নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাট করে। এই পটভূমিকায় ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে বিপুল ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণের ফলে এক অভূতপূর্ব সফল গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। এতে শাসকগোষ্ঠীর প্রতিহিংসার শিকার হয়ে শিশু ও নারীসহ এক হাজার চারশর বেশি নিরস্ত্র নাগরিক নিহত এবং বিশ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়। তাদের আত্মাহুতি ও ত্যাগের বিনিময়ে এবং জনগণের সম্মিলিত শক্তি ও প্রতিরোধের কাছে স্বৈরাচারী শাসক ও তার দোসররা পরাজিত হয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।

গণঅভ্যুত্থান জনগণের মননে রাষ্ট্রকাঠামো পুনর্গঠনের একটি প্রবল অভিপ্রায় সৃষ্টি হয়েছে উল্লেখ করে জুলাই সনদে রাষ্ট্র সংস্কারের যে ঐতিহাসিক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, তার সদ্ব্যবহার সবার পবিত্র দায়িত্ব বলে উল্লেখ করা হয়।

এছাড়াও, রাজনৈতিক দলগুলো সনদে যুক্ত আইনি, ঐতিহাসিক ও সাংবিধানিক সুরক্ষাসমূহের সংরক্ষণ ও শ্রদ্ধা জানাবে; ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের আলোকে একটি ন্যায়ভিত্তিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের মৌলিক পদক্ষেপ হিসেবে এই সনদকে স্বীকৃতি দেবে এবং ঘোষণার শেষাংশে ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনে নিহত শহীদদের স্মরণ করে শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক উপায়ে আন্দোলনের লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়নে সব পক্ষকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানানো হয়েছে।

জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংস্কার প্রস্তাব চূড়ান্ত করতে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে গত ১২ ফেব্রুয়ারি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়। ১৫ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে এ কমিশনের যাত্রা শুরু হয়। এ কমিশনের মেয়াদ আগামী ১৪ আগস্ট শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। এর আগেই কমিশন তার কাজ সম্পন্ন করবে।

Post a Comment

Previous Post Next Post